ন্যায়বিচার নিয়ে শঙ্কা

সংগৃহিত

আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে বিএনপি, জামায়াতসহ ভিন্নমতাবলম্বীদের যেভাবে একের পর এক মামলায় আসামি করা হয়েছিল, হাসিনা সরকারের পতনের পর এখন আবার একই কান্ডের পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে নির্বিচারে বিক্ষোভকারী ছাত্র-জনতাকে গুলি করে হতাহতের ঘটনায় প্রতিদিনই রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক মামলা হচ্ছে। অধিকাংশ মামলাতেই এজাহারের বর্ণনা প্রায় অভিন্ন। পাল্টাচ্ছে শুধু স্থান-কাল-পাত্র। মামলায় ঢালাওভাবে পুলিশ থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতাসহ দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের আসামি করা হচ্ছে। একটি মামলায় সহস্রাধিক জনকেও আসামি করা হচ্ছে। অভিযোগ উঠেছে, কিছু কিছু মামলায় ক্ষেত্রবিশেষে রাজনৈতিক স্বার্থ, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব ছাড়াও হীন উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টাও রয়েছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রকৃত ভুক্তভোগীদের সুবিচার প্রাপ্তি নিয়ে রীতিমতো শঙ্কা প্রকাশ করছেন ফৌজদারি আইনের বিশেষজ্ঞরা।

ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একেকটি মামলায় কয়েকশ থেকে কয়েক হাজার পর্যন্ত আসামি করা হচ্ছে। এত সংখ্যক আসামির বিরুদ্ধে তদন্তের ভিত্তিতে অপরাধ প্রমাণ করতে কয়েক যুগ লেগে যেতে পারে। সেই সঙ্গে ঢালাও মামলার কারণে অভিযোগের সত্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ফলে সুবিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারে ভুক্তভোগী পরিবার। আওয়ামী লীগের আমলেও বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এভাবে মামলা করে আদালতে হাজিরা আর কারাগারে বন্দি রাখার মাধ্যমে শুধু হয়রানি করা হয়েছে। ন্যায়বিচার নিশ্চিতে উচিত হবে আইনজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শের মাধ্যমে আসামি সুনির্দিষ্ট করে মামলা করা।

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, পুলিশ প্রাথমিকভাবে যাচাই-বাছাই করে মামলা নেওয়ার কথা থাকলেও সেটা হচ্ছে না। আদালতে মামলা করতে গেলে ম্যাজিস্ট্রেট জবানবন্দি গ্রহণ করে বাদীকে পরীক্ষা করবেন। তিনি বলেন, মামলায় আগে বিএনপি নেতাদের নাম দিত, এখন সেই স্থানে আওয়ামী লীগ নেতাদের নাম দিচ্ছে। মামলার ধরন একই। এভাবে ফৌজদারি মামলা হয় না। বিএনপির নেতাদের বিরুদ্ধে শত শত মামলা হয়েছিল। এখনো হুকুমদাতাসহ কয়েকশ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে। এই মামলার তদন্ত শেষ করতে কত বছর লেগে যাবে চিন্তা করেন। আমার দৃষ্টিতে এসব মামলার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অন্তত ১১৫টি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় শেখ হাসিনার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক

ওবায়দুর কাদেরসহ দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে। ইমন হোসেন গাজী হত্যার ঘটনায় তার ভাই আনোয়ার হোসেন

গাজী গত ২৮ আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, ১ নম্বর আসামিসহ (শেখ হাসিনা) তার সহযোগীরা গণভবন ও বিভিন্ন কার্যালয়ে বৈঠক করে (ছাত্র-জনতাকে) গণহত্যার পূর্ব পরিকল্পনা করে। শেখ হাসিনার নির্দেশ পালনের জন্য ৬ নম্বর আসামি (সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল) আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর সরাসরি গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। সেই নির্দেশ পালনের জন্য মামলার ৩১ নম্বর আসামি (তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন) তার অধীনস্থ কর্মচারীদের সর্বোচ্চ বল প্রয়োগের নির্দেশ দেন। ১ নম্বর আসামির নির্দেশে সরকারের অনুগত পুলিশ, র‌্যাব, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্তরা মরণঘাতী অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

আনোয়ার হোসেন তার ভাইকে হত্যার ঘটনায় ৮৪ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করেছেন। এ ছাড়া আরও ৮৪ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। আনোয়ার হোসেন যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা দায়েরের দুই দিন আগে ২৬ আগস্ট মামলা করেন ভোলার মো. ইউসুফ। তার সন্তান আরিফকে হত্যার ঘটনায় মামলা দায়ের করেন। মামলার অভিযোগের ধরন একই হলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৩৩ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছে। অজ্ঞাত আসামি ২৫০ থেকে ৩০০ জন।

অধিকাংশ মামলার আসামি আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও এমপি। পোশাককর্মী রুবেলকে হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে ক্রিকেটার ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। অথচ তিনি সে সময় দেশের বাইরে ক্রিকেট নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। এই হত্যা মামলায় বাকি অভিযুক্তরা হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদেরসহ আরও ১৫৬ জন। আর অজ্ঞাতনামা ৪শ-৫শ জনকে আসামি করা হয়।

রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও পুলিশের পাশাপাশি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবসায়ীদের নামেও হত্যা মামলা দায়েরের অভিযোগ রয়েছে। ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ফকির গ্রুপের কর্ণধারসহ তিনজনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক ফকির গ্রুপের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ফকির গ্রুপের কারখানাগুলোর ঝুট নিতেন নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু। কিন্তু ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর মোটা অঙ্কের চাঁদা ও ঝুট ব্যবসা দখলে নিতে বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক তাদের কারখানার গুদামে তালা ঝুলিয়ে দেন। বিষয়টি বিএনপির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালে তালা খোলা হলেও ফকির নিটওয়্যার লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির আক্তারুজ্জামান, তার ভাতিজা ফকির ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির কামরুজ্জামান নাহিদ ও ফকির গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির মাশরিকুজ্জামানের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দেওয়া হয়। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও পুলিশের সঙ্গে তাদেরও মামলায় জড়ানোর ফলে ভয়াবহ ব্যবসায়িক ও মানসিক চাপে রয়েছেন।

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমিয়ে রাখতেও মামলা করার অভিযোগ করা হচ্ছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নেতারা জানান, তাদের দল সমর্থিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬৭ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর হাজি মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। অথচ ৫ আগস্টের আগে তিনি ডেমরা, চিটাগাং রোড, সাইনবোর্ড ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ইসলামী শ্রমিক আন্দোলন ঢাকা মহানগরীর নেতা সিরাজুল ইসলাম আকনকে ওলামা লীগের উপদেষ্টা দেখিয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় দায়ের করা মামলায় আসামি করা হয়েছে।

মামলার পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীর পাশাপাশি পুলিশের শতাধিক কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বাধিক ৩৮টি মামলার আসামি হয়েছেন ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তার নামে ৩৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ ছাড়া পুলিশের সাবেক আইজি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের নামে ৩৬টি; সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের নামে ৩৩টি; ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের নামে ২৭টি; সাবেক এসবি প্রধান মনিরুল ইসলামের নামে ১১টি মামলা হয়েছে।

গত ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের আগে ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা ও নাশকতার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলার একটি বড় অংশের আলামত হিসেবে পুলিশ বাঁশের লাঠি ও ইটের টুকরা উদ্ধার করেছে। মামলার ধরন ও বিবরণ প্রায় একই। শুধু স্থান ও সময় আলাদা। গত ১৯ জুলাই মোহাম্মদপুর থানার এসআই আদনান বিন আজাদের দায়ের করা মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে, বিএনপি, জামায়াত-শিবির ও তাদের অঙ্গসংগঠনের শীর্ষ নেতাকর্মীদের নির্দেশে কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মিশে লোহার রড, লাঠিসোটা ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে এবং পুলিশের সরকারি কাজে বাধা ও হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণ করে। ঘটনাস্থল থেকে ২৭টি বাঁশের লাঠি, কিছু কাচ ভাঙা টুকরা ও ৪০টি ইটের ভাঙা টুকরা উদ্ধার করা হয়। মামলার প্রধান আসামি বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম। একই থানায় ২১ জুলাই এসআই মধসূদন মজুমদার বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার প্রাথমিক তথ্যবিবরণীতে বিবরণ একই। শুধু ২৭টি বাঁশের লাঠির বদলে উদ্ধার দেখানো হয়েছে ২৫টি বাশের লাঠি এবং ৪০টি ভাঙা ইটের টুকরার বদলে ১০০টি টুকরা উদ্ধারের কথা বলা হয়। একই থানায় একই দিন এসআই ফাহাদ হাসানের দায়ের করা মামলায় প্রাথমিক তথ্যবিবরণীতে প্রায় একই বিবরণ দেওয়া হয়। তবে বাঁশের লাঠি ৩০টি এবং ইটের টুকরা ১৫টি।

একাধিক রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গল্প সাজিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দিয়ে হয়রানি করা হতো। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নামে ময়লার গাড়ি পোড়ানোর মামলা দেওয়া হয়েছিল। মোবাইল ফোন চুরি ও ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনতাইয়েরও অভিযোগেও মামলা দেওয়া হতো। সেগুলো গায়েবি মামলা হিসেবে পরিচিতি। তখন মামলার বাদী পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপটে নিহতের স্বজনদের মাধ্যমে মামলা দিলেও বাদী অধিকাংশ আসামিদের চেনে না। হত্যা মামলা করার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে দেওয়ার বিধান থাকলেও বেশির ভাগ আসামির ক্ষেত্রে ‘হুকুমদাতা-নির্দেশদাতা’ উল্লেখ করা হয়েছে। এ ধরনের মামলা তদন্তে দীর্ঘসূত্রতার পাশাপাশি আদালতে টেকার সম্ভাবনাও কম। তাই ঢালাও মামলা না করে ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে যাচাই-বাছাই করে সুনির্দিষ্টভাবে মামলা করা প্রয়োজন।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বিচারে ও ঢালাওভাবে আসামি করে মামলা দায়ের কোনোভাবেই কাম্য নয়। এটি অনৈতিক ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। মামলাগুলো বস্তুনিষ্ঠ হওয়া প্রয়োজন। প্রকৃত ঘটনা নিরূপণ করে দোষী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা এবং নির্দোষ ব্যক্তিকে হয়রানির হাত থেকে মুক্ত করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সব অংশীজনের দায়িত্ব। তথ্যগত অসামঞ্জস্যতা ও অসঙ্গতি মামলাকে দুর্বল করে ফেলে। যথাযথ যাচাই-বাছাই করে মামলা করা না হলে প্রকৃত অপরাধী পার পেয়ে যেতে পারে এবং তাতে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের ন্যায়বিচার প্রাপ্তিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।