মহান বিজয় দিবস, পঞ্চাশে নতুন বিজয়ের শপথ
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের অবিনাশী কথামালার ভাষণটি বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ভাষণটি শুধু বাঙালি জাতিকেই মুক্তির পথ দেখায়নি, সারা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষও মুক্তির প্রেরণা পেয়ে থাকে এখান থেকে। এর ব্যঞ্জনা ও তাৎপর্য অনেক গভীর। পরতে পরতে লুকিয়ে আছে মানবমুক্তির আকাক্সক্ষা। ভাষণের একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ হ্যাঁ, আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি। দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রাম বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি পায় ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। আজ বিজয়ের ৫০তম দিন। প্রতি বছরের মতো দিনটিতে অন্ধকার ভেদ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ গড়ার জন্য অঙ্গীকার করে বাঙালি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীকে সামনে রেখে এবারের বিজয় দিবসের তাৎপর্য ও ব্যাপ্তি বিশাল। জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে লড়াইয়ে অনেকটা সফল হয়েছে দেশ। তবে ধর্মীয় মৌলবাদ বারবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। এসেছে গণতন্ত্রের ওপর আঘাতও। দেশের পঞ্চাশতম বিজয় দিবসে নতুন বিজয়ের করে শপথ নিতে হবে। কোভিড-১৯ সংক্রমণে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা জানাতেও ভুল করবে না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত জনসমাবেশে জাতীয় স্মৃতিসৌধসহ সারাদেশের অস্থায়ী বেদিতে ফুলেল শ্রদ্ধা জানানো হবে।
বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন পৃথক পৃথক কর্মসূচিও নিয়েছে। আজ স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিত না থাকলেও তাদের পক্ষে সামরিক সচিবরা শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক পৃথক বাণীতে দেশের মানুষের কল্যাণ কামনা করেন এবং স্বাধীনতার সুফল সব মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান। বিজয়ের ৫০ বছরে পা দেওয়ার ক্ষণে বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারা এগিয়ে নিতে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে বলেন রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে দেশে আজ গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত। সরকারের নিরলস প্রচেষ্টায় ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর ক্ষমতায়নসহ আর্থসামাজিক প্রতিটি সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। উন্নয়নের এ ধারাকে এগিয়ে নিতে সবার সহযোগিতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন। তা হলেই দেশ পরিণত হবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায়। বানীতে রাষ্ট্রপতি দেশে-বিদেশে বসবাসরত সব বাংলাদেশিকে বিজয়ের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন। ভাষণে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষদের বিজয়-নিশান সমুন্নত রাখার শপথ নাও এই বিজয় দিবসে। প্রতিজ্ঞা কর, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এ দেশকে সোনার বাংলাদেশে পরিণত করার।
আজকের বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর নয়। স্বাবলম্বী বাংলাদেশ। একটা সময় ছিল আমাদের উন্নয়ন বাজেটের সিংহভাগ আসতো বিদেশি অনুদান থেকে। আজ বাজেটের ৯৭ ভাগ মেটানো হয় নিজস্ব অর্থায়নে। বাংলাদেশ কারও দয়া বা করুণার ওপর নির্ভরশীল নয়।
অসাম্প্রদায়িক মানবিক গণতান্ত্রিক চেতনার ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জাতি তা থেকে রাজনীতিকে পাকিস্তানি ধারায় ফেরানোর কাজ হয়েছে। হানাদারবাহিনীর দোসরদের পুনরুত্থান ঘটেছে, রাজনীতি ও সমাজে তাদের ভাবধারার প্রসার ঘটেছে। তার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছে বর্তমান সরকার এবং জঙ্গিবাদ দমনে অনেকটাই সফল হয়েছে। মৌলবাদী শক্তি সম্প্রতি রাতের অন্ধকারে বঙ্গবন্ধুর নির্মীয়মাণ ভাস্কর্য ভাঙার মতো ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে। এবারের বিজয় দিবসে জাতির সামনে স্বাধীন বাংলাদেশ ছাড়াও সম্ভবত স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় অর্জন পদ্মা সেতু মাথা তুলে সবার সামনে দৃশ্যগোচর হয়েছে। বিশ্বব্যাংক-এডিবির মতো শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবন্ধক দূর করে বাংলাদেশ এত বড় কাজটি নিজের অর্থে সম্পন্ন করতে চলেছে। অর্থনীতি ও সামাজিক সূচকে যে পর্যায়ে উন্নতি করেছে তা দক্ষিণ এশিয়ায় সবার চেয়ে এগিয়ে। মাথাপিছু গড় আয় ও আয়ু, নবজাত ও মাতৃমৃত্যু হ্রাস, টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়ন, প্রাথমিকে শতভাগ ভর্তি মিলিয়ে বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। বিস্ময়কর অগ্রগতি ঘটেছে কৃষি খাতে। বাংলাদেশ মাছ, সবজি, ফল, মুরগি, ডিম উৎপাদনে বিশ্ব পর্যায়ে গণ্য হচ্ছে। এর কোনো কোনোটিতে আমাদের অগ্রগতি বিশ্ব পর্যায়ে তৃতীয়-চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে। আবার করোনার দুঃসময়ে আমাদের রপ্তানি আয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, বরং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হার বেড়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভও বেড়েছে। বিশ্বের ও দক্ষিণ এশিয়ার মানদ-ে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণের হার কমই আছে, মৃত্যু হার কখনো ১.৫% শতাংশের ওপরে ওঠেনি।
বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাস কোভিড-১৯ সংক্রমণ, সাম্প্রদায়িক উসকানি এবং রাজনৈতিক সংকট কোনো কিছুই বীর বাঙালিকে দাবায়ে রাখতে পারবে না। বিজয়ের পথ ধরে স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে ভুল করবে না। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে সুখী, সমৃদ্ধ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় এ দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হবে এমন দৃঢ়প্রত্যয় বিশেষজ্ঞদের।
জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের প্রত্যাশা করেন, বিজয় দিবসের এবারের শপথ হোক- সব ধরনের হানাহানি ও বৈরিতা বিদ্বেষকে পেছনে ফেলে, দেশের ও জনগণের কল্যাণে সবাই এক হয়ে কাজ করবে। বিজয়ী জাতি কখনই পরাভব মানে না। বাংলাদেশ তার লক্ষ্যে অবিচল থাকবে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ অর্জন। গণতন্ত্র এবং অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে একটি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়েই স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছিলাম। সে লক্ষ্য পূরণে আজও কাজ করে যাচ্ছি। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছতে সক্ষম হব বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।’
ক্ষমতাসীন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী কর্নেল (অব) ফারুক খান বলেন, বিজয় শুধু আনন্দ দেয় না, আত্মবিশ্বাসও তৈরি করে। যে আত্মবিশ্বাসের কারণে অনেক ষড়যন্ত্র ও বাধা পেরিয়ে পদ্মা সেতু তৈরি করা যায়। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট, নদীর তলদেশে ট্যানেল তৈরিতে উদ্যোগ নেওয়া যায়। তবে আমাদের জন্য দুঃখের বিষয় স্বাধীনতার ৪৯ বছরেও উগ্রমৌলবাদী শক্তি অপচেষ্টায় লিপ্ত। যদিও তাদের বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি, সতর্ক থাকতে হবে সবাইকে। আমরা বাঙালি, আমরা বিনয়ী মুসলমান। বিজয় দিবস উপলক্ষে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কর্মসূচি পালন করবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, সিপিবিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
আওয়ামী লীগ সূর্যোদয়ের ক্ষণে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে, বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী সংগঠনের কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করবে। সকাল ৯টায় সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন, সকাল সাড়ে ৯টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, সোয়া ১০ বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। বিকাল সাড়ে ৩টায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সীমিত পরিসরে দলের আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হবে। আলোচনাসভায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য রাখবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করে স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিধি মেনে সারাদেশে যথাযথ মর্যাদায় মহান বিজয় দিবস উদযাপনের জন্য আওয়ামী লীগ এবং সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ী ও সর্বস্তরের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।
বিএনপির কর্মসূচি : জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দেওয়ার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোসহ নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। দলের প্রতিষ্ঠা সাবেক রাষ্ট্রপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান বীরউত্তমের কবরে শ্রদ্ধা ও তার রুহের মাগফিরাত কামনায় বিশেষ মোনাজাত করা হবে। ভোরে নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। দেশব্যাপী বিএনপির কার্যালয়গুলোয় জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। সকাল সাড়ে আটটায় সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে দলের উদ্যোগে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হবে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি : সকাল সাড়ে ৮টায় পার্টির পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয় নেতারা সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পমাল্য অর্পণ করবেন। সকালে কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশে পার্টি কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে।