বিশ্বের সবচেয়ে দামি পাখির বাসা !
বিশ্বের সবচেয়ে দামি সুইফটলেট পাখির বাসার স্যুপের কথা অনেকেই জানেন। যারা সেগুলো সংগ্রহ করেন, তাদের অবিশ্বাস্যয গল্প বলছেন ওমর শাহেদ
ভোর শুরু হলো, এদোয়ার্দো ‘দাদো’ গুয়েরিবা একদল সঙ্গী নিয়ে নৌকায় পাবেলনের তীরে পৌঁছালেন। ফিলিপাইনের খুব ছোট এই দ্বীপ সাগর তীরে, দ্বীপ দুটির মধ্যে পাহাড়ের উঁচু শৃঙ্গগুলো শান্ত, সুবজ-নীল সাগরের দিকে চেয়ে আছে। পাহাড়গুলোর কোনায় ছোট্ট কাঠের চালাঘর; বৃষ্টি-বাদলায় পাখির বাসা সংগ্রহকারীদের বাঁচায়। তারাই এগুলো তৈরি করেছেন। বিরাট চুনাপাথরের এই পাহাড় দুটির তুলনায় তাদের ঘরগুলো একেবারেই ছোট। জীবনকে যেন শাসায়। তাদের বয়ে আনা নৌকাগুলো ফিরে যাওয়ার পর, মানুষগুলো খালি পায়ে সাগরের তীর ধরে কাঁধে দড়ির গোছা, হাতে লম্বা বাঁশ বয়ে এগোতে শুরু করলেন। পাবেলনের পাখির বাসার সংগ্রাহক হিসেবে পরিচিত তারা। বাসাগুলো সুইফটলেট পাখির অনন্য শিল্প কৌশল। বাসাগুলোকে এই পাখিদের নামে ইংরেজিতে বলা হয় ‘অ্যারোড্রেমাস ফিউচিফিগাস সুইফটলেট’, বাংলায় আমরা অর্থ করি ‘সুইফটলেট পাখির বিষহীন বাসা’। পাখিরা শক্ত, মজবুত, ঝড়বাদলা সহ্য করা বাসাগুলো তাদের মুখের আঠাল লালা দিয়ে তৈরি করে। এগুলোই বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান প্রাণীর উৎপাদিত, মানুষের কেনা পণ্যদ্রব্য। বাসাগুলো দিয়ে বিখ্যাত সেই স্যুপ তৈরি করা হয়। চীনা কায়দায় তৈরি হয়, তারাই বেশি খায়। খুব স্বাদু, স্বাস্থ্যকর হিসেবে বিশ্বজুড়ে সুনাম আছে সুইটলেটের বাসার স্যুপের। চীন দেশের লোকেরা মনে করে, স্যুপ তাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বহুগুণে বাড়ায়। খুব ভালো মানের পাবেলনের এক কিলোগ্রাম ওজনের পাখির বাসার দাম এখন ১ লাখ ৮০ হাজার ফিলিপিনো পেসো। মার্কিন হিসাবে ৩ হাজার ৭৮৫ ইউএস ডলার, আমাদের টাকায় ৩ লাখ ২১ হাজার ৯৭৮ টাকা!
বাসাগুলোর খোঁজেই দলে দলে এই মানুষরা এসেছেন। তারা থাকেন একেবারে কাছের মাইতেগুয়েত দ্বীপপুঞ্জে। দলনেতা গুয়েরিবার বয়স এখন ৪৫। পাবেলনকে সারা বিশ্বের এক নামে পরিচিত করে দেওয়া এই পবর্তশৃঙ্গে ছয় বছর বয়স থেকে উঠছেন। তবে তিনিই সবচেয়ে পুরনো আরোহী নন। সেই কৃতিত্ব গঞ্জালো দে লেয়নের দখলে; ১৪ বছর বয়সে তিনি প্রথম পাখির বাসা পাহাড় বেয়ে সংগ্রহ করেছেন। কেমন ছিল আগের সেই দিন? গুয়েরিবা ফিরে গেলেন অতীতে ‘আমরা ১৯৫০ সালের পরে এই দ্বীপে আসা শুরু করেছি। তখন ১০ থেকে মাত্র ১৫ জন আরোহী ছিলেন। এখন ৫০ জনেরও বেশি আছি। তখন আমাদের দেশ ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা থেকে আসা এক চীন দেশীয় ভদ্রলোকের কাছে বাপ-দাদারা বাসাগুলো বিক্রি করতেন। তাদের মুখে শুনেছি, তিনি তাদের ১২ পয়সা করে প্রতি কিলো বাসার দাম দিতেন। তখনই তিনি ৩৫ পিলিপেনো পেসো প্রতিটি বাসার জন্য মধ্যস্বত্ব মজুরি আয় করতেন। সেটি খুব ভালো রোজগার ছিল।’ শুরু থেকেই সুইফটলেট পাখির বাসার বাজার খুব চড়া। কোথায় কোথায় তাদের ঠিকানা? পালাওয়ানের উত্তর দিকে টাইটাই সাগরে আছে পাবেলন। গড়ে উঠেছে দুটি চুনাপাথরের পাহাড়; ভাস্কর্যের মতো দেখতে পাহাড়গুলো পানির ওপর ভেসে আছে লাখ লাখ বছর ধরে। পাহাড়ের ওপরে আছে গোলক ধাঁধার মতো জটিল গুহার সারি। সেখানেই সুইফলেটদের বাড়ি। পাখিগুলোকে সংগ্রাহকরা স্থানীয় ভাষায় ডাকেন ‘বালিনসাসাওয়াও’। প্রতি ডিসেম্বর থেকে আগস্ট মৌসুমে পাখিরা মিলিত হয়, বাসা তৈরি করে, ছানার জন্ম দেয়। তাদের বাসা সংগ্রহ বিপজ্জনক। সংগ্রাহকদের স্থানীয়রা বলেন ‘বিজিয়াডোরস’। দুনিয়ার সবচেয়ে দামি এই পাখির বাসা এনে দেওয়া মানুষদের বেশির ভাগেরই কিন্তু পায়ে জুতো নেই; বাঁশ ও কয়েকটি মাত্র দড়ি নিয়ে ১০০ ফিট পর্যন্ত খাড়া পাহাড় বেয়ে তারা উঠে যান। এরপর পান গুহাগুলো। সেগুলোর ভেতরে পাথরের খাঁজগুলো বেয়ে খালি হাতে নামেন, ওঠেন; পিচ্ছল টিলা অন্ধকারে চলেন। ফলে পুরো কাজই হয় খুব কঠিন। আগে তো গাছের জ¦লন্ত ডাল জ¦ালিয়ে পথ খুঁজে হতো এই গরিবদের। এখন ছোট টর্চের বাতিতে কাজ করেন। গুয়েরিবা বললেন, ‘বাপ-দাদা যেভাবে উঠেছেন, সেভাবেই শিখে আমাদের দলগুলোর বেশির ভাগ সদস্যই খালি হাতে পাহাড় বেয়ে ওঠেন।’ তাকে ঝানু আরোহী দাদা ৪০ বছর আগে পাবেলনের গুহা বেয়ে ওঠা শিখিয়েছেন। সেই থেকে সেভাবে উঠছেন।
এমন অনেক পাহাড়শৃঙ্গ ও গুহা আছে, যেগুলোর গা ও মুখ বেয়ে, গুহার দেয়ালের ফাঁকা জায়গা পেরোতে পাখির বাসা শিকারিদের দড়ি লাগে, বাঁশ দিয়ে একে অন্যকে ধরে বেয়ে উঠতে হয়। চুনাপাথরের এই পাহাড় দুটি অমসৃণ, খুব বিপজ্জনক। অনেক বছর ধরে কাজ করছেন বলে তারা হাতের তালুর মতো চেনেন। তারপরও গুয়েরিবার ভয় কাটে না, ‘কিছু শিলাখ- সব সময় আলগা থাকে। ফলে প্রতিটি খন্ড হাত দিয়ে ধরে নিরাপদ কি না, নিশ্চিত হতে হয়। আমার সঙ্গেরই তো দুজন আত্মীয় চোখের সামনে পাহাড় থেকে পড়ে মারা গেছে। তারা আমার সঙ্গেই পাহাড়ে উঠছিল। সাবধান করেছিলাম, কখনোই যেন পায়ের নিচের শিলাখ- সম্পর্কে পুরো নিশ্চিত না হয়ে হাতগুলো সরিয়ে না নেয়। সেই ভুল করেছিল বলে ওদের প্রাণ গেছে।’ তারপরও জীবন তাদের এদিকে ঠেলে দিয়েছে। ভালোবাসা শিখিয়েছে।
সুইফটলেটের বাসা সংগ্রহের মৌসুম ‘ডিসেম্বর থেকে জুন’। তখন তারা দলে দলে ২০ থেকে ২৫ দিন পর পর গুহাগুলোতে ওঠেন। জুন-জুলাই দুই মাসে পরিযায়ী এই পাখিরা বাসা তৈরি করতে আসে। আগের নিয়মেই গুহার ভেতরে ছানার জন্ম দেয়। পরে আবার তারা বাসা সংগ্রহ অভিযানে যান।
প্রতিটি গুহা পাবেলনের সামাজিক রীতিতে এক একটি পরিবারের দখলে থাকে। তারা আলাদাভাবে বাসাগুলোর যতœ করেন, পাখির বাসা সংগ্রহ করেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। প্রতি ডিসেম্বরে পাবেলনে এসে অনেক কষ্টে, জীবন হাতে নিয়ে গুহাতে পৌঁছে প্রথমেই তারা দেয়ালগুলো পরিষ্কার করেন। আগের বছরের পড়ে থাকা ময়লা-আবর্জনা তুলে নেন মমতায়; যাতে পরিচ্ছন্ন দেয়ালে বাসা তৈরি করতে পারে পাখিবন্ধুরা। যদি তারা এই কাজ বৃষ্টি-ঝড়ের ওপর ছেড়ে দিতেন, তাহলে বাসা বানানোর উপযুক্ত হতে দেয়ালগুলোর বছরের পর বছর লেগে যেত। তাতে যেমন পাখির ক্ষতি হতো, ওরা আসত না, ছানা মরে যেত; তেমনি তাদের পেশারও খুব ক্ষতি হতো। এভাবেই পাখি ও মানুষগুলোর মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
এই বাসাগুলোর ইতিহাস আরও আছে। ১৯২০ সালে ফিলিপাইনের স্থানীয় প্রশাসন পাবেলনের পাখির বাসাগুলো সংগ্রহের বিশেষ সুবিধা সরাসরি ঠিকাদারদের কাছে বিক্রি করা শুরু করেছিলেন। ঠিকাদারদের বেশির ভাগই ছিলেন চীনা। তাদের হয়ে শ্রমিকের কাজ করতেন স্থানীয় এই গরিব শ্রমিকরা। তবে কাজ করতে করতে ১৯৯০ দশকের শেষে তারা পাখির বাসাগুলোতে রক্তের চিহ্ন দেখতে লাগলেন। বছরের পর বছরের অভিজ্ঞতায় বুঝে গেলেন পরিযায়ী পাখিগুলো চাপের মধ্যে অছে। চীনা ঠিকাদারদের হাতেই ছিল পাখির বাসা সংগ্রহের পুরো নিয়ন্ত্রণ। গুয়েরিবার মনে পড়ে, ‘তারা যত বেশি সম্ভব টাকা সংগ্রহ করতে চেয়েছিলেন। আমাদের জোর করে পাহাড়ে চড়াতেন। বাসায় ডিম থাকার পরও সেগুলো সংগ্রহ করতে বাধ্য করতেন। এসব কারণে নতুন পাখির জন্ম হচ্ছিল না, ছানারাও মরে যাচ্ছিল। ফলে আমরা ফিরে এসে তাদের কাছে কষ্টগুলো বারবার বললাম। অনুরোধ করলাম, কিছু বাসা অবশ্যই নতুন পাখির জন্ম দেওয়ার জন্য রেখে আসতে হবে। সেই বাসায় মা ডিমে তা দিয়ে ছানা ফোটাবে। তবে ওরা এই অনুরোধ ও উপদেশ পুরোপুরি উপেক্ষা করল এবং সব বাসা খুঁজে আনতে আমাদের জোরাজুরি, ধমক ও ভয় দেখাতে লাগল। এমনকি ডিমসহ বাসা আনতেও জোর করল। আমাদের কাজগুলো করতে হয়েছে।’ এরপর তারা ঘুরে দাঁড়ালেন।
২০০৫ সালে ঐতিহ্য ও এই জীবিকা ধরে রাখতে পাখির বাসার শ্রমিকরা সবাই মিলে একটি সমবায় সমিতি গড়ে তুললেন। স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে চীনাদের মুখোমুখি হলেন। তারা চলে যেতে বাধ্য হলেন। এরপর আরও অনেক উন্নত হয়েছে পাখিদের জীবন। গুয়েরিবার জানালেন, ‘আমাদের জীবন তো এই পাখির বাসাগুলো বিক্রি করে চলে। এখন আর কোনো মধ্যস্বত্বভোগী নেই। আমরা পাখির বাসা বাড়ানোর জন্য, ওদের ভালো রাখার জন্য কাজ করছি। তাদের ছানা জন্ম দেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় দিই। তাতে পরিযায়ী সুইটলেটরা প্রতি বছর আমাদের দ্বীপে আসছে।’
পাখির বাসার সংগ্রাহকরা সমিতির মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন ফিলিপেনো পেসো স্থানীয় সরকারকে আয়কর দেন। মার্কিন হিসাবে ৫৪ হাজার ৭১৮ ইউএস ডলার, আমাদের টাকায় ৪৬ লাখ ২৩ হাজার ৩২৭ টাকা! সেই টাকার ২০ শতাংশ তাদের পাবেলনের টেকসই উন্নয়নে খরচ করা হয়। যাতে মানুষগুলো ভালো স্বাস্থ্যের অধিকারী হন, ভালো খাবার খেতে পারেন, ভালো শিক্ষার সুযোগ পান, পরিষ্কার পানি পান করতে পারেন, ভালো বাথরুম ইত্যাদিসহ ভালো জীবনের দেখা পান। করের বিনিময়ে পাবেলন পৌরসভা তাদের পুলিশী সাহায্য দেয়। তাতে তাদের জীবনে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। আগে তারা চোর হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন। গভীর রাতে পাহাড়ের কাছে লুকিয়ে আসতেন। নৌকাগুলো দ্বীপ থেকে অনেক দূরে রেখে সাঁতার কেটে তীরে পৌঁছাতে হতো। খালি হাতেই অন্ধকারে উঠতে হতো পাহাড়ের গা। এখন দিনের আলোয় তারা কাজ করেন। ফলে মরেন না সেই সময়ের পাখিদের মতো।
(বিবিসি থেকে অনুবাদ)